সাখাওয়াত আল আমিন॥ পঁচাত্তরের ৩ নভেম্বর মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফ কর্নেল শাফায়াত জামিলের নেতৃত্বাধীন ৪৬ পদাতিক ব্রিগেডের সহায়তায় সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে জিয়াউর রহমানকে চিফ অফ আর্মি স্টাফ হিসেবে পদত্যাগ করতে বাধ্য করে তার ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের বাসভবনে গৃহবন্দী করে রাখেন।
খালেদ মোশারফের নির্দেশে তাকে বন্দী করে রাখার দায়িত্বে ছিলেন তরুণ ক্যাপ্টেন হাফিজুল্লাহ। জিয়াউর রহমান যেন কারও সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পারেন সেজন্য তার বাসার টেলিফোন সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়। কিন্তু ক্যাপ্টেন হাফিজুল্লাহ ভুলে যান জিয়ার বেডরুমেও একটি টেলিফোন ছিল। জিয়া কৌশলে বেডরুম থেকে ফোন করেন কর্নেল তাহেরকে। খুব সংক্ষেপে বলেন “সেভ মাই লাইফ”।
সেই একটি ফোনকলই শেষ পর্যন্ত হয়ে ওঠে ইতিহাস নির্ধারক। এই ফোন পেয়ে সেসময় চট্টগ্রামে অবস্থান করা তাহের ঢাকায় তার অনুগত সৈন্যবাহিনীকে প্রতিরোধ গড়ার নির্দেশ দিয়ে শত শত জাসদ নেতা-কর্মীকে নিয়ে নিজেও ঢাকার পথে রওনা হন। এক পর্যায়ে জিয়াকে মুক্ত করার পরই খুন হন মাত্র তিনদিন আগে অভ্যুত্থান ঘটানো খালেদ মোশাররফ। ইতিহাস গবেষক ও লেখক আনোয়ার কবিরের মতে ওইসময় খালেদ মোশাররফের অনুগত ক্যাপ্টেন ভুল না করলে ইতিহাস অন্যরকম হতে পারতো।
চ্যানেল আই অনলাইনতে তিনি বলেন: যদি সবগুলো টেলিফোন লাইন কাটা থাকতো তবে জিয়া কারও সঙ্গে যোগাযোগের সুযোগ পেতেন না। তাহলে তাহেরও হয়তো পাল্টা অভ্যুত্থান ঘটাতে উৎসাহী হতেন না।
ইতিহাসবিদদের মতে, কর্নেল তাহের ছিলেন জিয়াউর রহমানের একজন বিশেষ শুভাকাঙ্খী। তাদের মধ্যে সম্পর্কও ভালো ছিল। তাহের ছিলেন সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী। সৈনিক-অফিসার বৈষম্য তার পছন্দ ছিল না। তার এই নীতির জন্য তাহের সেনাবাহিনীর সাধারণ সৈনিকদের মাঝেও দারুণ জনপ্রিয় ছিলেন। তবে অনেকটা বোকার মতোই কর্নেল তাহের বিশ্বাস করতেন জিয়াও তারই আদর্শের লোক।
তাই জিয়ার আহ্বানে তৎক্ষণিক সাড়া দেন তাহের। তিনি ঢাকায় তার অনুগত ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সিপাহীদের পাল্টা প্রতিরোধ গড়ার নির্দেশ দিয়ে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা এসে পাল্টা অভ্যুত্থান ঘটান। তার এই পাল্টা অভ্যুত্থান সফল হয় ৭ নভেম্বর। তিনি জিয়াউর রহমানকে বন্দীদশা থেকে মুক্ত করে নিয়ে আসেন। খুন হন খালেদ মোশাররফ ও তার কয়েকজন সহযোগী।
বাংলাদেশের সামরিক বাহিনী এবং সেনা অভ্যুত্থানগুলো নিয়ে দীর্ঘ গবেষণা করা আনোয়ার কবিরের মতে, খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থান ব্যর্থ হওয়ার পেছনে তার নিজেরই কিছু ভুল ছিল। যা তাকে ব্যর্থতার দিকে নিয়ে যায়।
তিনি বলেন: যে কোন অভ্যুত্থান ঘটাতে গেলে কিছু সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা দরকার। খালেদ মোশাররফের সে ধরনের কোন পরিকল্পনা ছিল না। তাছাড়া ক্ষমতা সুসংহত করার জন্য রেডিও-টিভিতে সেগুলো প্রচারও করতে হয়। কিন্তু ৩ নভেম্বর থেকে ৬ নভেম্বর পর্যন্ত টিভি-রেডিও বন্ধ থাকায় দেশের মানুষ দ্বিধায় ছিল। তারা জানতই না যে দেশে কী হচ্ছে।
চার নেতাদের খুনীদের দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ দেওয়াও খালেদ মোশাররফের অন্যতম ভুল ছিল বলে মনে করেন তিনি।
‘জেলের ভেতর যে জাতীয় চার নেতা খুন হয়ে গেছেন, সেটা জানতেই পারেননি খালেদ মোশাররফ। খুন করে খুনিরা দেশ ছেড়ে যেতে চাইলে তাদের অনুমতি দেন তিনি; যা ছিল তার অন্যতম ভুল,’ বলেন আনোয়ার কবির।
“অনেকে বলে থাকেন, জিয়াকে বন্দী করার পর তার অনুগত সৈন্যরা মুভ করেছিল। কিন্তু এটা সত্য নয়। জিয়াকে বন্দী করার পর তার পক্ষে একজন সৈন্যও মুভ করেনি। মুভ করেছে কর্নেল তাহেরের নির্দেশে।’
ওইদিন জিয়া মুক্ত হওয়ার কারণে ৭ নভেম্বরকে ‘জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি’ দিবস হিসেবে পালন করে বিএনপি। তবে দিনটি ‘মুক্তিযোদ্ধা সৈনিক’ হত্যা দিবস হিসেবে দেখে আসছে আওয়ামী লীগ।