ছানাউল্লা, রিয়াদ প্রতিনিধি॥ গেম অফ থ্রোনস? আর কোনও অভিধাতেই কি একে ভূষিত করা যায়? ক্ষমতায় এসেই ভাইদের কারাদন্ডের নির্দেশ দিলেন যুবরাজ মহম্মদ বিন সলমন। দুর্নীতির যুক্তিতে। আর তাঁদের কারাদন্ডের নির্দেশ দেওয়ার ২৪ ঘন্টার মধ্যে অত্যন্ত রহস্যজনকভাবে চপার ক্র্যাশে মারা গেলেন সৌদির এক প্রিন্স।
প্রাক্তন ক্রাউন প্রিন্স মাকরিন বিন আবদুলাজিজের সন্তান প্রিন্স মনসুর বিন মাকরিন তাঁর রাজধানীতে দক্ষিণ ইয়েমেনের কাছে এক চপার ক্র্যাশে প্রাণ হারান রবিবার। তিনি সৌদির আসির প্রদেশের গভর্নরও। আট সরকারি অফিসারকে সঙ্গে নিয়ে হেলিকপ্টারে করে আকাশপথে সান্ধ্যভ্রমণে গিয়েছিলেন মাকরিন। খানিকক্ষণ পরই তাঁর চপারটি ভেঙে পড়ে। ঠিক কী কারণে এমনটা হল, সেটা অবশ্য জানায়নি সৌদির সরকারি সংবাদমাধ্যম। শনিবারই বিশ্বের অন্যতম প্রথম সারির ধনী আলওয়ালিদ-বিন তালাল-সহ ১১ ধনকুবের রাজকুমারকে দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেপ্তার করেছে সৌদি প্রশাসন। এঁদের মধ্যে চারজন আবার মন্ত্রী। একাধিক প্রাক্তন মন্ত্রীও রয়েছেন। এঁদের মধ্যে আলওয়ালিদের গ্রেপ্তারির খবরেই কিন্তু সবচেয়ে বেশি চাঞ্চল্য ছড়িয়েছে বিশ্বজুড়ে। কারণ তিনি শুধুমাত্র সৌদি রাজকুমারই নন, সিটি গ্রুপ, টুইটার, নিউজ কর্প-সহ একাধিক বিশ্বমানের সংস্থার অংশীদার তিনি। আরব দুনিয়ার স্যাটেলাইট নেটওয়ার্কও চলে তাঁরই অংগুলিহেলনে। সেই আলওয়ালিদের গ্রেপ্তারিতেই সবচেয়ে বেশি হইচই পড়েছে। শুধু তাই নয়, সৌদি ন্যাশনাল গার্ডের প্রধান ও একদা রাজ সিংহাসনের অন্যতম দাবিদারকেও বদলি করা হয়েছে।
বদলি করা হয়েছে দেশের নৌসেনা প্রধান ও অর্থমন্ত্রীকেও। বেশ অনেকদিন ধরেই দুর্নীতিমুক্ত আরব গড়তে উঠেপড়ে লেগেছেন যুবরাজ মহম্মদ বিন সলমন। বছর বত্রিশের এই যুবরাজের নেতৃত্বে একটি দুর্নীতিদমন কমিশন তৈরি হয়েছে সম্প্রতি। প্রধানত দেশবাসীর অর্থের সুরক্ষা, দুর্নীতিগ্রস্ত এবং প্রশাসনিক পদের অবমাননাকারীদের শাস্তি দেবে এই কমিটি। এই কমিটি তৈরির কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত ১১ রাজকুমারকে শ্রীঘরে পাঠানো হয়। কিন্তু এর পিছনে অন্য খবর রয়েছে বলেই রাজপরিবারের আনাচকানাচে খবর। অন্য তুতোভাইদের ক্ষমতা থেকে দূরে রেখে, কার্যত মসনদ থেকে সরিয়ে রাখতেই তাঁদের তড়িঘড়ি গারদে পোরার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে মনে করছে সৌদি রাজপরিবারের ঘনিষ্ঠরা। এদিকে, ইয়েমেনের হাউতি বিদ্রোহীরা সৌদির রাজধানী রিয়াধের বিমানবন্দর লক্ষ্য করে মিসাইল ছুড়েছে। ২০১৫-থেকেই সৌদি আরবের বিরুদ্ধে একাধিকবার সংঘর্ষে জড়িয়েছে ইয়েমেন। সৌদির নেতৃত্বে যৌথবাহিনী ইয়েমেনে মিলিটারি পাঠানোর সিদ্ধান্তের পর থেকেই যে কোনও উপায়ে হামলার ছক কষছে ইয়েমেন। ইয়েমেন সংঘর্ষে ৮০০০-এরও বেশি মানুষ মারা গিয়েছেন যখন সৌদি আরব ও আমেরিকার যৌথবাহিনী হাউতি বিদ্রোহীদের দমন করতে প্রেসিডেন্ট আবদ্রাব্বুহ মনসুরকে সমর্থন জানায়। হাউতিদের পিছনে আবার ইরানের সমর্থন রয়েছে।
এমনিতেই সৌদি পরিবারের অজস্র শাখাপ্রশাখা। তার উত্তরাধিকারীও অনেক। তাঁদের মধ্যে বরাবরই ক্ষমতার তখতে কে বসবেন তা নিয়ে লড়াই চলে। যে আলওয়ালিদের গ্রেপ্তারি নিয়ে এত হইচই তিনি সৌদি রাজপরিবারের সদস্য এবং রাজকুমার হলেও তাঁর বয়স কিন্তু প্রায় ৬২। মাস ছয়েক আগের হিসেবেই তাঁর সম্পত্তির পরিমাণ ছিল ১৭১০ কোটি ডলার। টাইম ম্যাগাজিনের সেরা ১০০ তালিকাতেও স্থান পেয়েছেন তিনি। হলিউডের প্রযোজনা সংস্থা টুয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরি ফক্সের বড় অংশীদারও তিনি। তাঁর গ্রেপ্তারির ফলে শেয়ার বাজারের দর এক লাফে অনেকটা পড়ে যায়। রাতারাতি প্রায় ৭৫ কোটি ডলার ক্ষতি হয়েছে তাঁর কোম্পানিগুলোর। সেই আলওয়ালিদকেই যুবরাজের পদে এসে কারাগারে ভরলেন তাঁর প্রায় অর্ধেক বয়সি যুবরাজ মহম্মদ বিন সলমন। রাজকুমাররা যাতে দেশ ছেড়ে পালাতে না পারেন তাই বেসরকারি বিমানের জন্য বরাদ্দ জেদ্দার বিমানবন্দরও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এমনটাই অনুমান একাংশের। এই আলওয়ালিদকেই মসনদ থেকে দূরে রাখতে তাঁকে কারাগারে ভরেছেন সলমন। মনে করছেন আলওয়ালিদ অনুরাগীরা। ফলে শীতের শুরুতেই ‘উইন্টার ইজ কামিং’।
যুবরাজের এই পদক্ষেপকে সমর্থন করেছেন সৌদি সরকারি বিভাগের অনেক উচ্চপদস্থই। তাঁরা জানিয়েছেন, দুর্নীতি দমনের এই পদক্ষেপ সন্ত্রাস দমনের থেকেও গুরুত্বপূর্ণ। অন্যদিকে, কূটনৈতিক মহলের একাংশের দাবি, যুবরাজের ক্ষমতা আরও বাড়াতেই রাজ পরিবার এত বাড়াবাড়ি করছে। কারণ তিনি রাজা সলমনের প্রিয় পুত্র ও প্রধান পরামর্শদাতা। সৌদি রক্ষা, বিদেশ-আর্থিক ও সামাজিক নীতিতে তাঁর সিদ্ধান্তই শেষ। রাজ পরিবারের যে কোনও ইস্যুতেও তিনিই শেষ সিদ্ধান্ত নেন। সৌদি দেশটি পুরোটাই রাজ পরিবারের ইচ্ছায় চলে। কোনও লিথিত সংবিধান, আদালত বা পার্লামেন্ট নেই। তাই দুর্নীতির অভিযোগ উঠলে তা যেমন যাচাই করা অসম্ভব, তেমনই অসম্ভব যুবরাজের যে কোনও সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করা। সবমিলিয়ে সৌদির পরিস্থিতি এই মুহূর্তে বেশ জটিল।