…..আর যুক্তরাষ্ট্রের সাত বছরের স্বাধীনতা যুদ্ধ, যার সবটা ছিল সশস্ত্র বিপ্লব ব্রিটিশ রাজার সুশাসনের আড়ালে আপাপ্ন শোষণের বিরুদ্ধে । সে যুদ্ধও যে ছিল সংখ্য লঘু জনগণের যুদ্ধ সেটাও বোধহয় অনুপাতে সিদ্ধ। সে গল্পটা জানলে বাদবাকি সব জলবৎ তরলং হয়ে যাবে বলে আমার বিশ্বাস। যুদ্ধ যখন দখলদার ব্রিটিশকে অনেকটা কোণঠাসা করে ফেলেছিল তখনও অনেক মানুষ তারস্বরেই বলেছে সূর্য পশ্চিম দিকে উদিত না হলে ব্রিটিশ রাজের সুশিক্ষিত দুধরর্ষ সেন্যদের হারাতে পারবে না নগ্নপদ নবিশ মুক্তিযোদ্ধারা । কোথায় মিলিশিয়া আর কোথায় বিশ্বসেরা ব্রিটিশ সৈন্য ! কিসে আর কিসে ধানে আর তুষে ! রাজানুগতরা ব্রিটিশের পক্ষে দাঁড়িয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের হেনস্থা করলো, নিকুচি করলো, নিধন মারলো। এত কিছু করে রাজানুগত্যের প্রমাণ রাখলো। ফরাসি বন্ধুরা জর্জ ওয়াশিংটনের পাশে এসে দাঁড়ালো। ব্রিটিশ পৈঁ পৈঁ করে পালাতে লাগলো। তখন হাজার হাজার রাজভক্ত ক্রিতদাস তাদের জাহাজে যেয়ে উঠলো। আর পলায়নরত ব্রিটিশ তাদেরকে নিয়ে অন্য বন্দরে আবার ক্রিতদাস বানিয়ে বেচে দিল। সাদারা ব্রিটেনে যেয়ে পৌঁছালো বটে, তবে মানুষ তাদের মুখে থুতু ছিটালো। লয়ালিস্টদের (রাজাকার) মধ্যে যারা পালাবার পথ পেলোনা তাদের হ’ল করুণ অবস্থা । তাদের মাথা মুড়িয়ে মুখে চুনকালি মাখিয়ে গাধার পিঠে উল্টো চড়িয়ে শহর ঘুরালো মুক্তিযোদ্ধারা। তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত হলো। সম্পদগর্বী স্থুল নারী ঘর হারিয়ে গোয়াল ঘরে স্থান পেলো। নিজের শষ্য ক্ষেতে নিড়ানি দিয়ে তবে ক্ষিদের অন্ন পেলো। সেই ভাগ্য বিড়ম্বিত লযালিস্টরাই একসময় আবার সব ব্যবসা বাণিজ্য বাগিয়ে নিলো নতুন শাসকদের তাবেদারি করে । তারাই এক শতাংশ মানুষ যাদের হাতে এখন যুক্তরাষ্ট্রের ৮০ ভাগ সম্পদ জমেছে । আর তাদের মোসাহেবদের হাতে রয়েছে বাকি ১৯ ভাগ। মোসাহেবরা জনসংখ্যার ৯ শতাংশ। আর ১০ শতাংশ হ‘ল তাদের তল্পিবাহক, পদলেহী ও সুবিধাভোগী। ৮০ ভাগ মানুষ ভাগ্যবঞ্চিত। কিন্ত সোনার শিকল পরা তোতাপাখি তারা। এ চিত্র এখন প্রায় পৃথিবীর সব দেশেই। কোথাও হয়ত ছবি ক্যানভাসে পরিণতি পাচ্ছে এখনও শিল্পির তুলি বেয়ে। সে অসম্পূর্ণতা হয়ত পূর্ণ হবে অচিরেই।
তবে বাস্তবতা এটাই যে, দেশে দেশে যে রক্তক্ষয়ী বিপ্লব হয়েছে যুগে যুগে। তাতে পৃথিবীর রঙ বদলে গেছে। শোষকের চেহারা বদল হয়েছে । কিন্তু শোষণের অবসান হয়নি। এখনও শোষকরা আনুগত্য চায়। আনুগত্য আর ধর্মান্ধতা টাকার এপিঠ ওপিঠ। মানুষের অন্ধ বিশ্বাস যদি অটুট থাকে তাহলে শোষণ অক্ষয় হবে। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যানভাসে সে চিত্রের পরিপূর্ণতা দৃষ্টিগোচর হয় এ সময়।
শোষণের আর একটি হাতিয়ার হ‘ল মানুষের ভাষ্।া মোঘল শাসনামলে ফার্সি ভাষার মোড়কে ভারতবর্ষের সমস্ত শিক্ষা সংস্কৃতি ঐতিহ্য শ্বাসরুদ্ধ হয়েছিল। ব্রিটিশ এসে ইংরেজি ভাষার জগদ্দল পাথর চাপিয়ে দিয়ে শোষণ পাকাপোক্ত করেছিল। রাজকাজে ফার্সি ভাষার বিলুপ্তি ঘটাতে ইংরেজির পাশাপাশি বাংলা ঠাঁই পেয়েছিল ১৮৩৫ সালে । কিন্তু শিক্ষায় ছিল ভিন্ন চিত্র। ১৯৩৬-৩৭ এর আগে ম্যাট্রিক (স্কুল ফাইনাল) পরীক্ষা অব্দি ইংরেজি বাধ্যতামূলক ছিল।
ভাষা আগ্রাসনের মধ্য দিয়ে শাসিত ও পদানত জাতিসত্তাকে বিলীন করে দিয়ে শোষণ শাসন পাকাপোক্ত করার প্রাচীন তত্ত্বের আবিষ্কারক হচ্ছেন স্প্যানিশ ভাষাতাত্বিক এলিও অস্তানিও ডি নেব্রিহা। স্পেনের রাণী তখন ইসাবেলা।। কথিত আছে রাণীকে তুষ্ট করার জন্যে ভাষাবিদ নেব্রিহা ক্যাস্তিলিও ভাষায় একটি ব্যাকরণ বই লিখে রাণীকে উপহার দেন। সেই বইএর ভূমিকায় তিনি লেখেন,“ ভাষাই সেই হাতিয়ার যা সব সময় সাম্রাজ্যের দোসর হয়ে থেকেছে। ভবিষ্যতেও থাকবে। একযোগে তারা বিকশিত হয়। তাদের অবক্ষয়ও হয় এক সাথে। ভাষাই হবে মানুষের মন ও মস্তিষ্কের ওপর রাষ্ট্রের আধিপত্য বিস্তারের প্রধানতম হাতিয়ার। “নেব্রিহার এই অভিনব তত্ত্বই সম্ভবতঃ পাকিস্তানের নব্য শোষকগোষ্ঠিকে প্রভাবিত করেছিল। সেই প্রভাব কাটাতে আমাদের পথ দেখিয়েছিলেন মওলানা ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরে বাংলা একে ফজলুল হক। রাজপথে সংগ্রামের সূচনা করে মুক্তি ও স্বাধীনতার মহাকাব্য রচনা করেছিলেন রাজনীতির কবি আমাদের জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান। ভাষা আন্দোলন ছিল মহান মুক্তিযুদ্ধের ভিত্তিমূলে ন্যস্ত প্রথম শিলাখন্ড।
ভাষা দিয়ে শোষণ পাকাপোক্ত করার লক্ষ্যেই দেশ বিভাগের ছ মাসের মাথায় ইংরেজির সাথে উর্দু জুড়ে ১৯৩৫ সনের ব্রিটিশ আইনের সংশোধনী আনা হ‘ল গণপরিষদে। সরকারি সেই বিলের সংশোধনী আনলেন সাংসদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। তিনি দাবি করলেন দেশের সংখ্যা গরিষ্ঠ ৫৪ শতাংশ ৪ কোটি ৪০ লক্ষ নাগরিকের মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করতে হবে। তাঁর সেই বেসরকারি সংশোধনী প্রস্তাব সমর্থন করলেন কংগ্রেস সদস্য শ্রীশ চন্দ্র টট্ট্রোপাধ্যায়, ভূপেন্দ্র কুমার দত্ত্ব ও হেমহরি বর্মা । প্রধান মন্ত্রী নওয়াবজাদা লিয়াকত আলী খান সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে নাকচ করলেন সে সংশোধনী প্রস্তাব। সরকারি বেতার যন্ত্র এবং সংবাদ মাধ্যম গোয়েবেলসীয় কায়দায় জোর ডঙ্কা বাজলো, হিন্দুরা বাংলা রাষ্ট্র ভাষা দাবি করে দেশের সংহতি নষ্ট করার প্রয়াস পাচ্ছে।
মার্চ মাসে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ভাষা সংগ্রাম দুর্বার হ‘ল। সহস্র বছরের দ্বন্ধ ভুলে হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খৃষ্টান এক কাতারে দাড়িয়ে ভাষা সংগ্রামকে সেক্যুলার বিপ্লবে রূপান্তরিত করলো। শাসকগোষ্ঠী ভীত সন্ত্রস্ত্র হয়ে ৪৯-৫০ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধিয়ে হাজার হাজার মানুষকে দেশছাড়া করলো। প্রাণভয়ে ১০ হাজার ভাষা সংগ্রামী বামপন্থী দেশ ত্যাগ করলেন। ৫২ সালের ২১ -২২ ফেব্রুয়ারি শহীদের রক্তে রাঙা হ‘ল বাংলার সবুজ মাটি। ভাষা আন্দোলনের রক্তসিঁড়ি বেয়ে ইতিহাস এগিয়ে গেলো একাত্তরের পটভূমিতে। রাজনীতির কবি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রচনা করলেন মুক্তি ও স্বাধীনতার মহাকাব্য। ৩০ লাখ হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খৃষ্টান অকাতরে প্রাণ দিয়ে লিখলো স্বাধীনতার বিজয় গাথা। সেক্যুলার বিপ্লবের নতুন ইতিহাস রচিত হ‘ল। হানাদাররা ২৫ মার্চ’৭১ নিরস্ত্র জনগনের ওপর ঝাপিয়ে পড়ার কয়েকদিনের ভিতর ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত নির্মম হত্যার শিকার হলেন।
যারা বলেছিলেন ভাষা আন্দোলন ব্যর্থ হবে, কারণ ইংরেজি বাদ দিলে শিক্ষার মান পড়ে যাবে। তারা আবার বললেন, পাকিস্তান না থাকলে ইসলাম পথ হারাবে। পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ সেনা বাহিনীর বিরুদ্ধে লুঙ্গিপরা গেও মানুষের যুদ্ধ হাতির সাথে ব্যাঙের পাল্লা দেয়ার মত। মতের ও পথের সেই যে বিভাজন, তা আজও বহাল আছে। আলোকিত মানুষ আর কুয়োর ব্যাঙদের মনস্তাত্ত্বিক সংঘাত কোন দিনও শেষ হওয়ার নয়। তবে অন্ধ বিশ্বাস টিকিয়ে রাখার প্রবল প্রচেষ্টা বলবৎ হয়েছে। সবারই মন এখন ঘুমের ঘোরে “জিহাদ জিহাদ“ করছে। কারণ মানুষ ধর্মান্ধতা হারিয়ে বিদ্রোহী হলে কতিপয় মানুষের হাতে পুঞ্জিভূত সম্পদ নিয়ন্ত্রণ হারাবে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী সম্পদের এই বৈষম্য দূর করতে মরিয়া হয়েছেন । কারণ এমন বিত্তব্যবধান ১৩০ কোটি মানুষের সমাজে শান্তি বিনষ্ট করবে। ইউরোপের অবস্থাও তথৈবচ। চীন রাশিয়াও সমাজের সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ স্তরে সম্পদের বিশাল ব্যবধান কমিয়ে আনতে গলদঘর্ম হচ্ছে।
শামসুল আরেফিন খান