প্রশান্তি ডেক্স॥ শান্তির ধর্ম ইসলামকে নামের সাথে জুড়ে নিলেও শান্তির সাথে জামায়াতে ইসলামীর কোনো সম্পর্ক নেই। জামায়াত মানেই অশান্তি, জামায়াত মানেই নৃশংসতা, জামায়াত মানেই নাশকতা। তাই নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে, আমার ভয় তত বাড়ছে। জামায়াতের প্রশিক্ষিত কর্মী আছে, অর্থ আছে, প্রতিশোধের নেশা আছে। নির্বাচন যতই এগুবে, পানি যত ঘোলা হবে; জামায়াত ততই সামনে আসবে। হতে পারে বিএনপির কোনো শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে নাশকতা করে জোটকেই বিপাকে ফেলতে পারে। জামায়াতের আসলে হারানোর কিছু নেই। তাই তারা এখন বেপরোয়া আচরণ করতে পারে। তাই সতর্ক থাকতে হবে সবাইকে। জামায়াতকে ঠেকানোর দায়িত্ব সরকার বা আওয়ামী লীগের একার নয়; শুভ চিন্তার সব মানুষকে এক হতে হবে। নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশজুড়ে এখন ভোটের আলোচনা। আওয়ামী লীগ-বিএনপি তো আছেই; তুমুল আলোচনা যুক্তফ্রন্ট আর ঐক্য প্রক্রিয়া নিয়েও। আলোচনায় থাকার চেষ্টা করছে জাতীয় পার্টিও। বাম জোট, নাজমুল হুদা, কাদের সিদ্দিকীরাও নানা ঘাট খুঁজছেন। কিন্তু রহস্যজনকভাবে কোনো আলোচনায় নেই বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বড় খেলোয়াড়- জামায়াতে ইসলামী। কেউ কেউ বলছেন, যে দলের নিবন্ধন নেই, যে দল নিজেদের প্রতীকে নির্বাচন করতে পারবে না, তাদের নিয়ে আলোচনার কী আছে।
এটা ঠিক নির্বাচনে অংশ নিতে হলে জামায়াতকে হয় বিএনপির সাথে মিলে ‘ধানের শীষ’ প্রতীকে অংশ নিতে হবে, নয় স্বতন্ত্র। এটা ঠিক গত ১০ বছরে জামায়াত তাদের ইতিহাসে সবচেয়ে খারাপ সময় পার করছে। এই সময়ে তাদের প্রায় শীর্ষ নেতা যুদ্ধাপরাধের দায় নিয়ে হয় ফাঁসির দড়িতে ঝুলেছে, নয় বিচারের অপেক্ষায় কারাগারে আছে। যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যনাল, রাজপথ, জোট, নির্বাচন কমিশন; সব জায়গায় জামায়াতের জন্য দুঃসংবাদ। নিবন্ধন বাতিল হলেও জামায়াতকে এখনও নিষিদ্ধ করা হয়নি। যদিও ট্রাইবুনালের একাধিক রায়ে দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীকেও মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত করা হয়েছে। আনুষ্ঠানিকভাবে নিষিদ্ধ করা না হলেও জামায়াত তৎপরতায় নিজেদের প্রায় নিষিদ্ধ করে রেখেছে। জামায়াতে ইসলামী দেশের, রাজনীতির কতটা অনিষ্ট করতে পারে; একাত্তর থেকেই তা হাড়ে হাড়ে বুঝিয়ে দিয়েছে। একাত্তরে জামায়াতে ইসলামী, তাদের তখনকার ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘ, তাদের গড়া আল বদর, আল শামসের সহায়তায় পাকিস্তানি হানাদাররা এ দেশে হত্যার উৎসব করেছিল।
স্বাধীনতার পর ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়। কিন্তু ৭৫-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে জিয়াউর রহমান ধর্মভিত্তিক রাজনীতির অনুমতি দেন। তারপর থেকে জামায়াতে ইসলামী তাদের একাত্তরের অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করার মিশন নিয়ে মাঠে নামে। বিভিন্ন সময়ে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ফুলে ফেঁপে উঠে জামায়াত-শিবির অশুভ চক্র। ছাত্রসংঘের উত্তরসূরী ইসলামী ছাত্রশিবির দেশের শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানগুলোকে কসাইখানা বানিয়ে ফেলে। মূল দল জামায়াতে ইসলামীও সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নিয়ে জাঁকিয়ে বসার চেষ্টা করে।
শুধু রাজনীতি নয়, চতুর জামায়াত ব্যবসার মাঠও দখলে নেয়ার চেষ্টা করে। তারা জানে, রাজনীতি করতে হলে টাকা লাগে। মধ্যপ্রাচ্যের টাকায় ফুলে ফেঁপে উঠে তাদের বাণিজ্য। অনেক চেষ্টা তদবির করেও জনগণের হৃদয়ে জায়গা হয়নি তাদের। সব মিলিয়ে তাদের ভোট ৫ শতাংশের ওপরে উঠেনি। জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্যতা না পেলেও নৃশংসতা আর ষড়যন্ত্রের রাজনীতিতে পারদর্শী জামায়াতে ইসলামী নানা কানাগলি পেরিয়ে পৌঁছে যায় ক্ষমতার কাছাকাছি। বিএনপির বদান্যতায় জাতীয় পতাকা ওড়ে স্বাধীনতাবিরোধী মতিউর রহমান নিজামী আর আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের গাড়িতে। বিএনপি-জামায়াত জোটের ৫ বছরে নিজামী-মুজাহিদ সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়িয়ে দেয় সমাজের আরো গভীরে।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে জামায়াতের বিষ দাঁত ভেঙে দেয়ার চেষ্টা করেছে। প্রথম সারির নেতারা যুদ্ধাপরাধের দায়ে ফাঁসিতে ঝুলেছে, দলের নিবন্ধন বাতিল হয়েছে। কিন্তু দ্বিতীয়-তৃতীয় সারির নেতা, সাথী, সদস্যরা কিন্তু রয়ে গেছে। তাদের অর্জিত অর্থও কিন্তু তাদের কাছেই আছে। ভয়টা সেখানেই। জামায়াত-শিবির কী করতে পারে, তার ভয়াবহতা অনেকবারই দেখেছে বাংলাদেশ। সাঈদীকে চাঁদে দেখা যাওয়ার গুজব ছড়িয়ে জামায়াত দেশে যে কান্ডব চালিয়েছে, তা মনে হলে এখনও শিউড়ে ওঠে জাতি। ২০১৪ সালের নির্বাচন এবং পরের বছর তার বর্ষপূর্তিতে বিএনপি দেশজুড়ে যে পেট্রোল সন্ত্রাস চালিয়েছে তার জ্বালানি জুগিয়েছে জামায়াত।
তাই জামায়াতকে আলোচনার বাইরে রাখাটা ভয়ঙ্কর। তলে তলে জামায়াত কী নাশকতার ষড়যন্ত্র করছে, তা আমাদের উদ্বিগ্ন করে। আমাদের পছন্দ না হতে পারে, কিন্তু জামায়াত একটি সুসংগঠিত আদর্শভিত্তিক দল। তারা এখন হয়তো ঘাপটি মেরে আছে বা গা বাঁচাতে বিভিন্ন দলে যোগ দিয়েছে। তারা কিন্তু কেউ জামায়াতকে ছেড়ে দেয়নি। আমার শঙ্কা, জামায়াত-শিবির সুযোগের অপেক্ষায় তাদের বিষ দাঁতে শান দিচ্ছে। আওয়ামী লীগের আমলেই যে তাদের নেতাদের ফাঁসিতে ঝুলতে হয়েছে, তাদেরকে দৌড়ের ওপর রেখেছে; তাই তারা নিশ্চয়ই নির্বাচনকে সামনে রেখে গভীর ষড়যন্ত্র করছে। যত সুষ্ঠু নির্বাচনই হোক, একা নির্বাচন করলে জামায়াতের জনপ্রিয়তার গোমর ফাঁস হয়ে যাবে। দুয়েকটা আসন পেলেও পেতে পারে, না পাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। শুধু সংগঠিত কর্মী আর প্রশিক্ষিত ক্যাডার দিয়ে তো আর ভোটে জেতা যায় না। নির্বাচনে জিততে জনগণের ভোট লাগে। জামায়াতের সব আছে, খালি জনসমর্থন নেই। গত কয়েক বছরে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যনালে একের পর এক রায়ে সংগঠন হিসেবে জামায়াত এবং তার নেতাদের অপরাধের ফিরিস্তি জেনে গেছে মানুষ। তাই ২৭ বছর আগে ৯১ সালে একক নির্বাচন করে ৫ শতাংশের মতো ভোট পেয়েছিল জামায়াত। সেটাকে পুঁজি করেই বিএনপির সাথে গাটছড়া বাঁধে জামায়াত। ৫ শতাংশ ভোটের ভয় দেখিয়ে বিএনপির ঘাড়ে চেপে আছে সিন্দাবাদের দৈত্যের মতো।
বিএনপির যদি এই ৫ শতাংশের ভয়টা কেটে যায়, তারা যদি জেনে যায় জামায়াতের ভোটের বাক্সে লাল বাতি জ্বলে গেছে, তাহলে জামায়াতকে ছুঁড়ে ফেলতে একটুও দ্বিধা করবে না বিএনপি। কারণ বিএনপির জাতীয় ঐক্যের আকাঙ্খার পথে সবচেয়ে বড় বাধা জামায়াত। যুক্তফ্রন্ট, গণফোরামের মতো সুশীল দলগুলো বিএনপির সাথে মিশতে পারছে না, জামায়াতের দুর্গন্ধ তাদের গায়েও লাগতে পারে এই ভয়ে। আর বিএনপির ভয় কেটে যাওয়ার পথটা জামায়াতই দেখিয়ে দিয়েছে। সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ২০ দলীয় জোটের মনোনয়ন চেয়েছিল জামায়াত। না পেয়ে ক্ষুব্ধ জামায়াত নিজেদের শক্তি দেখাতে নির্বাচনের মাঠে রয়ে যায়। সিলেটে তাদের ভোটব্যাংক আছে ধারণা করে কল্পনায় সুখের সাগরে ভাসছিল জামায়াত। ভেবেছিল সিলেটে নিজেদের শক্তি দেখিয়ে আগামী নির্বাচনের সওদাটা ভালোভাবে করতে পারবে, জোটে নিজেদের প্রভাব বাড়াতে পারবে। কিন্তু হলো উল্টো। জামায়াতের এখন কাপড় সামলানোই দায়। সিলেটে বিএনপি প্রার্থী জিতেছে আর জামায়াত প্রার্থী জামানত হারিয়েছেন। সিলেটে বিশ্বাসঘাতকতার পরও বিএনপি যে এখনও জামায়াতকে ২০ দলীয় জোটে রেখেছে, স্রেফ দয়া করে। বিএনপি যদি ড. কামাল, বি চৌধুরীদের কাছে টানতে জামায়াতকে ছেড়ে দেয়, তাহলেই তাদের জারিজুরি ফাঁস হয়ে যাবে।
শান্তির ধর্ম ইসলামকে নামের সাথে জুড়ে নিলেও শান্তির সাথে জামায়াতে ইসলামীর কোনো সম্পর্ক নেই। জামায়াত মানেই অশান্তি, জামায়াত মানেই নৃশংসতা, জামায়াত মানেই নাশকতা। তাই নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে, আমার ভয় তত বাড়ছে। জামায়াতের প্রশিক্ষিত কর্মী আছে, অর্থ আছে, প্রতিশোধের নেশা আছে। নির্বাচন যতই এগুবে, পানি যত ঘোলা হবে; জামায়াত ততই সামনে আসবে। হতে পারে বিএনপির কোনো শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে নাশকতা করে জোটকেই বিপাকে ফেলতে পারে। জামায়াতের আসলে হারানোর কিছু নেই। তাই তারা এখন বেপরোয়া আচরণ করতে পারে। তাই সতর্ক থাকতে হবে সবাইকে। জামায়াতকে ঠেকানোর দায়িত্ব সরকার বা আওয়ামী লীগের একার নয়; শুভ চিন্তার সব মানুষকে এক হতে হবে।
প্রভাষ আমিন: সাংবাদিক, কলাম লেখক; বার্তা প্রধান, এটিএন নিউজ।