তড়িঘড়ি কোচিং বাণিজ্য, বন্ধ কী ষড়যন্ত্র

প্রশান্তি ডেক্স॥ একটা খুব ছোট্ট খবরে সারা দেশের অধিকাংশ মানুষের মনের উপর দিয়ে সুনামী বয়ে যাছে সবার অলক্ষ্যে। কারণ মহামান্য হাইকোর্ট কোচিং বাণিজ্যকে একটি নতুন ধরনের অপরাধ বলে রায় দিয়েছেন। কোচিং বাণিজ্য বন্ধে করা এক রিটের শুনানিতে গত রোববার হাইকোর্ট এ রায় দেন। রিটের শুনানিতে হাইকোর্ট বলেন, ক্লাস রুমে পড়ানোর ব্যর্থতার কারণেই কোচিং বাণিজ্য হচ্ছে। এটি একটি নতুন অপরাধ।’ শুনানি শেষে কোচিং বাণিজ্য বন্ধের বিষয়ে রায় পিছিয়ে আগামী ৭ ফেব্রুয়ারি ধার্য করা হয়েছে। আসলেই এই কোচিং বাণিজ্য বন্ধ হওয়া দরকার। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে কখন থেকে তা বন্ধ হবে, ধপাস করে, না পর্যায়ক্রেমে? এটা নিয়েই হতে পারে একটা চরম বিতর্ক। যেহেতু একটা উন্নত জাতি গঠনের জন্য উন্নত শিক্ষা খুবই গুরুত্বপূর্ণ তাই তা ভেবে চিন্তেই করা দরকার। tare gore koching banejjo
এই ভারতবর্ষে এক সময় গুরুগৃহে, মাদ্রাসায় পাঠদান করা হতো। পরে ব্রিটিশ উপনিবেশ আমলে দুই ধরণের স্কুল চালু হয়। ব্রিটিশদের সাহায্য করার জন্য ইংরেজী শিক্ষা চাপিয়ে দেওয়া হয় অনেকটা জোর করেই। তবুও সে সময় শিক্ষা ছিল অনেকটা ব্রত। পরে সেটা পেশায় রূপ নেয়। কিন্তু বর্তমানে শিক্ষা আর ব্রত বা পেশা নেই শিক্ষা এখন সারা দুনিয়ায় বিশেষ করে উন্নত বিশ্বে পন্য হিসেবে বিক্রি করা হয়। তাঁর ঢেউ আমাদের দেশেও লেগেছে। এখানেও শিক্ষা বাণিজ্য চলছে চরমে।
অনেক উন্নত দেশেও শিক্ষায় রাষ্ট্রীয় ভর্তুকি দেওয়া হয় এখনো। তাদের লক্ষ্য আর্থিকভাবে অচ্ছলদের শিক্ষিত করে গড়ে তোলা। আমরা দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সরকারী হিসাবটা একটু দেখে নিতে পারি এই ভর্তি বাণিজ্যের সাথে এর কোন যোগসূত্র খুঁজে পায় কি না। প্রাথমিকে মোট সরকারি শিক্ষকের সংখ্যা ৩ লক্ষ ২২ হাজার ৭৬৬, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মোট ছাত্র/ছাত্রীর সংখ্যা ২ কোটি ১৯ লক্ষ ৩২ হাজার ৬৩৮, বর্তমান সরকারের সময় শিক্ষক নিয়োগের সংখ্যা ১ লক্ষ ৩০ হাজার ১০০ প্যানেলভুক্ত শিক্ষকের সংখ্যা ৪২ হাজার ৬১১ জন, প্যানেল হতে নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকের সংখ্যা (আগস্ট ‘১৬)৩২ হাজার ৯৬১ জন, অবশিষ্ট প্যানেলভুক্ত শিক্ষকের সংখ্যা ৭ হাজার জন, প্রাক-প্রাথমিক শাখার শিক্ষকের সৃজিত পদ সংখ্যা ৩৭ হাজার ৬৭২, প্রাক-প্রাথমিক শাখার নিয়োগকৃত শিক্ষকের সংখ্যা ৩৪ হাজার ৮৯৫। বেসরকারী বাদ দিয়ে শুধু সরকারী প্রাথমিকের ছাত্রদের হিসেব আমলে নিলে শিক্ষক প্রতি প্রতিদিন গড়ে মোট ৬৭৯ জন ছাত্রকে শিক্ষাদানের দায়িত্ব বর্তায়। এক বা দুই বছরের প্রাক-প্রাথমিক দিয়ে প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষাকে ৭ টা শ্রেনীতে ভাগ করলেও শ্রেণিপ্রতি প্রায় ১০০ জন ছাত্রের শিক্ষা দানের দায়িত্ব পড়ে প্রতি শিক্ষকের। এটা কী বাস্তবে সম্ভব?
দেশ উন্নত হচ্ছে তাই মাস্টার্স বা গ্রাজুয়েশন ডিগ্রীটা আন্তর্জাতিক মানের করতে গিয়ে ডিগ্রী, কলেজ, উচ্চ বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিকের শিক্ষা কারিকুলামের অনেক পরিবর্তন করা হয়েছে। কিন্তু শিক্ষকের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ নেই। প্রাথমিকে দক্ষ শিক্ষক নেই, দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার কারিকুলাম অনুপাতে। নেই পর্যাপ্ত শিক্ষা উপকরণ। তাঁর উপরে ‘যার নেই কোন গতি, সেই করে পন্ডিতি’ এমন মনভাব আমাদের দেশের মানুষের মাঝে। তাই বড় কর্তাদের বিবেচনায় প্রাথমিকের শিক্ষকদের বেতন খুব কম। ফলে বাঁচার জন্য তাঁরা আয়ের বিকল্প উৎস খুঁজতে বাধ্য হন। আবার বেতন কম বলে ভালো ছাত্ররা উন্নত দেশের মত করে আমাদের দেশে শিক্ষকতায় আসেন না। অনেক ক্ষেত্রেই শিক্ষকগন পারেন না বলেই ক্লাসে পড়ানো হয় না ঠিকমতো। ফলে সিলেবাস কমপ্লিট হয় না, কিন্তু ফাইনাল পরীক্ষায় প্রশ্ন ঠিকই আসে দেয় সিলেবাস অনুযায়ী। ফল খারাপ হয় ছাত্র ছাত্রীর, বাবা মা হন শংকিত। কারণ আমাদের দেশে সেকেন্ডারী আর টারশিয়ারী ব্যবসাতে যুক্ত হচ্ছে, হতে হচ্ছে, তাই উন্নত, উপযুক্ত শিক্ষার কোন বিকল্প নেই। আর তার শুরু হতে হবে প্রাথমিকে। এটা বাড়ী তৈরির মত, ফাউন্ডেশন ভালো না হলে যেমন বহুতল বাড়ি করা যায় না, ঠিক তেমনি প্রামিকের শিক্ষার ভিত ভাল না হলে কেউ উচ্চ শিক্ষা নিতে পারে না।
বাংলাদেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা হু হু করে বাড়ছে। বিষয় জ্ঞান ছাড়া সার্টিফিকেট নিয়ে লাভ নেই, তা সবাই কম বেশি জেনে গেছেন। তাই সবাই এখন উন্নত শিক্ষা চান, সবখানেই। মানে কোয়ালিটি শিক্ষা চাহিদা বেড়েই চলেছে দিন দিন। কারণ দেশীয় কারিকূলামে বাংলা আর ইংরেজী ভার্সনের পরে তাদের পাশাপাশি আমাদের দেশে ব্রিটিশ কারিকূলাম দিয়ে অনুন্নত ইংরেজী মাধ্যমে যারা পড়ে তাদের সাথে দেশী কারিকূলামে পড়া ছাত্ররা পেরে ওঠে না।
সব চেয়ে মোদ্দা কথা হচ্ছে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় নৈতিকতা শিক্ষা নেই। ফলে শিক্ষাদানেও নৈতিকতা বালাই নেই কোনখানেই। বাজারে বিস্তর অভিযোগ আছে যে, এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যারা পরিচালনা করেন, সেই সব পরিচালনাকারীদের নৈতিকতার বালাই নেই, আছে টাকার হিসাব, মোটা অংকের।
সব শেষে একটা কথা বলা যায় যে, ডিমান্ড থাকলে সাপ্লাই থাকবে। কয়েক বছর আগেও ভারত থেকে গরু চুরী করে আনতে গিয়ে বহু মানুষ প্রাণ দিয়েছে, এখন দেয় না, কেন? দেশেই অনেক গরু উৎপাদিত হচ্ছে। তাই চাহিদা নেই বলে তথা কথিত ‘সর্বজনীন গরু চোরাচালান’ আর নেই। আছে উপর মহলের মাধ্যমে বড় বড় চালানে হাড্ডিসার গরুর আমদানী চালান, চোরা চালান।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অক্লান্ত পরিশ্রম আর চেষ্টায় আমরা উন্নয়নের মহা সড়কে উঠেছি। তাই নানা ধরণের সমস্যা আমাদের সামনে আসবে, আসতেই হবে। আবার এগুলোর সমাধানও খুব জরুরী। কিন্তু কোনটা আগে আর কোন টা পরে সেটা জানা, বুঝা আরও বেশী জরুরী। তা না হলে উন্নয়নেরবর্ণচোরা শত্রুরা সারা দেশের প্রায় এক কোটি পরিবারের মানুষকে ক্ষেপিয়ে তুলতে পারে অসময়ে কম গুরুত্বের কাজ গুরুত্ব দিয়ে করার সুযোগ নিয়ে। তাই সাবধান হতে দোষের কী! তড়ি ঘড়ি করে কোচিং বাণিজ্য বন্ধ কেন? আমাদের তো ‘সর্বাঙ্গে ব্যাথা, ওষুধ দেবো কথায়’?
সায়েদুল আরেফিন

Leave a Reply

Your email address will not be published.