প্রশান্তি ডেক্স॥ চিরচেনা ঢাকা একটু একটু করে নয়, আচমকা বদলে গেলো। ৮ মার্চ প্রথম করোনা রোগী সনাক্ত হয়। তারপর একটা ভয় জেঁকে বসে মনে। তখনতো সবাই এতটা সচেতন হয়নি। ছেলে-মেয়েকে বোঝাই, স্বামীকে বোঝাই— পাত্তাই দেয় না। এরমধ্যে ইতালি ফেরত সবাই কোয়ারেন্টিনে না থেকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেলো ঘরে ঘরে। আশঙ্কায় বুক কাঁপে। করোনায় করণীয় নিয়ে হাসপাতালে জরুরি মিটিং। আমরা বিভিন্ন পদক্ষেপ নেবার কথা আলোচনা করি। হাসপাতালের রোগীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত হয়। আমাদের মনে ভয়। পিপিই নেই। ডাক্তার, নার্স, ওয়ার্ড বয়, পরিচ্ছন্নতা কর্মী, টেকনোলজিস্ট— সবাইকে সচেতন করতে থাকি। বাসায় এসে হাত সাবান দিয়ে ধুয়ে সোজা গোসলে ঢুকি। মনে হয় সারা শরীরে করোনার অবাধ বিচরণ। আমার ভয় লাগে। ১৭ মার্চ জাতির জনকের জন্ম শতবার্ষিকীর সব অনুষ্ঠান বাতিল হয়। সংক্ষিপ্ত আকারে কিছু কার্যক্রম চলে। আমাদের তখন যুদ্ধের পস্ত—ুতি শুরু হয়। স্কুল কলেজগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। আমরা তাৎপর্য বুঝতে পারি না। সদলবলে বেড়াতে যাই বিভিন্নখানে। ক্রমশ অরক্ষিত হতে থাকি সবাই। আমার বড় ভয় করে।২৫ মার্চ শেষ অফিস হয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ১০ দিনের ছুটির ঘোষণা দেন। ২৬ মার্চ আমাদের মহান স্বাধীনতা দিবস। স্মৃতিসৌধে কেউ নেই। নেই কোনো কুচকাওয়াজ, নেই আড়ম্বরপূর্ণ কোনো উৎসব। চিরচেনা ঢাকাকে চিনতে পারি না। লাল সবুজে ছেয়ে যায় না পথঘাট। এর মধ্যে ঢাকা ছাড়তে শুরু করেছে সবাই। ঢাকায় বসবাসের উপযোগী কোনো ব্যবস্থা নেই। মেসগুলো বন্ধ, খাবার হোটেল বন্ধ, আয় রোজগারের সুযোগ নেই। মানুষ দিগ্বিদিক হয়ে বাড়ী ছোটে। বাস, লঞ্চ, ট্রেন— উপচে পড়ে মানুষের ভিড়ে। সবাইকে দেখে মনে হলো হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার পিছনে ছুটছে। অদৃশ্য কেউ বাঁশি বাজায়, মন্ত্র মুগ্ধের মত আমরা ছুটতে থাকি।গ্রামেগঞ্জে পৌঁছে যায় মানুষ। সামাজিক দূরত্বে থাকা হয় না কারো! আমার খুব ভয় করে। গণপরিবহন বন্ধ হয়। শপিংমল, সিনেমাহল, কফিশপ— সব বন্ধ হয়। ক্রমশ মিইয়ে পড়ে ঢাকা। শুনশান নীরবতার প্রাচীর ভাঙা হয় না আমাদের। কোনো ট্রাফিক জ্যাম নেই। নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া রাস্তায় কেউ নেই। গাড়ির আওয়াজ নেই। কান বিদীর্ণ করা শব্দ নেই। এত নীরবতা ঢাকার আনাচকানাচে, ভীষণ অচেনা মনে হয়। আমরা সবাই গৃহে অন্তরীণ। বারবার হাত ধুই সাবানের ফেনা তুলে বিশ সেকেন্ড, তিরিশ সেকেন্ড; আমার হিসাব থাকে না। আমার ভেতরে ভয় বাসা বাঁধে।পাড়ার টংঘরে কেউ কেউ আসে চায়ের নেশায়। কেউ কেউ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে দোকানে। সবখানে সব কিছু পাওয়া যায় না। সবার চোখে মুখে ভয়। বাসার ছাদ থেকে রাস্তা দেখি। জনমানবহীন রাস্তা, গাড়িবিহীন রাস্তা— জীবনের কোলাহল বিহীন রাস্তা। খুব করে মনে করতে চেষ্টা করি আগের সেই সময়। মিরপুরে মেট্রোরেল আর ফ্লাইওভার নির্মাণ থমকে আছে। কয়দিন আগেওতো এই রাস্তায় চলাচল দুর্বিষহ ছিল। এমন ঢাকা আমার খুব অচেনা। আমার কেমন জানি ভয় করে। এরমধ্যে টোলারবাগের দুজন মারা যান। তাঁরা মসজিদে নামাজ পড়তেন পাঁচ ওয়াক্ত। ছেলেকে নিষেধ করি মসজিদে যেতে। বাসায় জুম্মা না হোক, জোহরের নামাজ আদায় করে। স্বামী মানতে চায় না। সে মসজিদে যায়। ফেরত আসার পর তাঁকে আমার করোনা বাহক মনে হয়। পরের জুম্মায় সে আর যায়নি। নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল। টিভি, রেডিও, ফেসবুকজুড়ে সারাক্ষণ করোনার খবর। বৈশ্বিক এই মহামারী কেড়ে নিয়েছে হাজার হাজার প্রাণের জীবন স্পন্দন। একেকেটা পরাক্রমশালী দেশ নুইয়ে পড়ছে করোনার ভয়াল থাবায়। আতঙ্কিত জনপদ, আতঙ্কিত জীবন। মৃত্যুর মিছিল ক্রমশ দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর। থামছেই না, কেউ থামাতে পারছে না। প্রমাণ হয় আসলেই মানুষ কত অসহায়। আসলেই মৃত্যুর কাছে জীবন কত অসহায়। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র একটা ভাইরাসের কাছে সকল ক্ষমতা তুচ্ছ হয়ে যায়। আমি ভীষণ ভয় পাই, ভীষণ। ঢাকার বাহিরেও করোনা ছড়িয়ে গেছে। যারা ঢাকা থেকে গেছেন তারা গৃহে আবদ্ধ।ঢাকায় এখন কোনো কর্মচাঞ্চল্য নেই, কারো কোনো ব্যস্ততা নেই। সবাই কেমন ঝিমিয়ে গেছে কুর্চা মুরগির মত! কিছু স্বেচ্ছাসেবক কাজ করছে পাড়ায় পাড়ায়, পুলিশের নজরদারি, আর্মিদের টহল, সাংবাদিকদের ক্যামেরা তৎপর, ডাক্তারের কোনো ছুটি নেই.,ব্যাংকে সন্ত্রস্ত মানুষের আনাগোনা এই ঢাকা আমার অচেনা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ভিডিও কনফারেন্সে দিক নির্দেশনা দেন। আইডিসিআর প্রতিদিন করোনার আপডেট জানায়। আমরা যেন যুদ্ধকালীন সময় পার করছি। ১৯৭১ সালের কথা মনে পড়ে। রেডিও নিয়ে আব্বা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র শুনছে। আমরা সবাই যুদ্ধরত! আজ আমার তেমনটাই মনে হয়। টিভির পর্দায় চোখ রাখি। সারাক্ষণ ফেসবুক স্ক্রল করতে থাকি। নতুন নতুন আক্রান্ত হবার খবর, নতুন নতুন মৃত্যুর খবর। চীন, ইতালি, স্পেনের পর বিপর্যস্ত এখন নিউইয়র্ক— কোনো দেশই করোনা ভাইরাস থেকে আর সুরক্ষিত নেই।সাদা চামড়া, কালো চামড়া, মুসলিম, হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ— সবাই যে মানুষ এটা প্রমাণ করতেই বোধ করি করোনার তান্ডব থামে না। রাজা, রাণী, উজির, নাজির— সবাই মানুষের কাতারে ক্ষমতার জোর করোনার ওপর খাটে না। আসলে মানুষ কত অসহায়! আমি ভয়ে সিঁটিয়ে যাই। থেকে থেকে মনে হয় আমি অন্য কোনো সময়ের গল্প শুনছি! তখন আমি ছিলাম না। সময়টা ছিল বড্ড বাজে। গল্পটা শেষ হলেই হয়তো আবার আমি ব্যস্ত হয়ে যাবো কাজে! বিশ্বাস হয় না আমার, মোটেই বিশ্বাস হয় না— এই সময়টা আমার, আর আমি আছি এই সময়ের সুতোয় বাঁধা। রূপকথার দৈত্যের মত মনে হয়, ডাইনির মত মনে হয়, ভৌতিক ব্যাপার মনে হয়,অশুভ কোনো অতৃপ্ত আত্মার গল্প মনে হয়! নিজেকে চিমটি কাটি বিস্ফোরিত চোখে দেখি আমার শরীর এটা! আমি ভয়ে চোখ বুঁজি। দুঃস্বপ্নের ঘোর কাটুক আমার হয়তো আমাদের চিরচেনা পৃথিবী আর আগের মত থাকবে না। হয়তো করোনা থামবে একদিন। কিন্তু রেখে যাবে তার চিহ্ন এই বিরাণ পৃথিবীর বুকে।অর্থনৈতিক মন্দাগ্রস্ত হবে সবাই। অর্থনীতির চাকা ঘুরবে না। সামাজিক বন্ধনে হয়তো চিড় ধরবে অথবা জোরদার হবে বন্ধন। বৈশ্বিক এই ক্ষয়ক্ষতির পরিমাপ জানি না! তবে কতদূর পিছিয়ে যাবো আমরা? কত পথ আবার এগুতে হবে…. আমরা কেউ জানি না। শুধু আশংকা ছেয়ে নেয় আমায়! পৃথিবীর অসুখ আজ। প্রকৃতি হয়তোবা প্রতিশোধ নেয়! আমরা হয়তো অনেক কর্মফল জড়ো করেছি—আজ প্রাণীকুলের জাগরণ দেখি। দেখি পক্ষীকূলের অবারিত উড়ে যাবার নীলাকাশ। আমরা মানুষ আমরা মানুষের মত বাঁচতে চাই এই আকালে। আমরা জীবনের গতিময়তা চাই। গতিজড়তা আর স্থিতি জড়তা আমাকে ভাবায়। লাশের মিছিল বন্ধ হোক। বন্ধ হোক ভয়ের ছায়া। জীবনের জন্য মায়া ছড়াই, ভালবাসায় আবার আমরা হাসতে চাই প্রাণখুলে। এই দুঃস্বপ্ন কেটে যাক। কেটে যাক ভয়ংকর দিনলিপি। পরিবর্তিত পৃথিবীতে মানুষের জীবন বেঁচে থাক। বেঁচে থাক মানবতা। আমার শহর আবার একদিন কোলাহল মুখর হোক, আবার আমরা ব্যস্ততায় বলে উঠি— সময় নেই, একদম সময় পাই না। এই অখন্ড অবসর আমার না, এই বন্দীত্ব আমার না, এই নির্জীবতা আমার না। ততদিন আমরা ধৈযের পরীক্ষা দেই.ঘরে থাকি, সামাজিক দূরত্বে থাকি। একলা থাকার প্রয়াসে থাকি। হাঁচি-কাশি র শিষ্টাচার মেনে চলি। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকি। বারবার হাত ধুই। বাইরে গেলে মাস্ক, গ্লাভস ব্যবহার করি। এতটুকুই আমরা পারি আমরা এতটুকু করলেই বেঁচে যাবে জীবন। জীবনের জয় হোক। মানবতার জয় হোক। লেখক: ফারহানা নীলা, চিকিৎসক ও লেখক