প্রশান্তি ডেক্স॥ করোনার কারণে কর্মহীন সময় যাচ্ছে আমার। শয়নে স্বপনে, ধ্যানে, প্রার্থনায় খালি করোনা আর করোনা। এই অফুরন্ত অবসরে আমি লিখালিখি বাদ দিয়েছি প্রায়। লিখতে গেলেই করোনার কথা চলে আসে ঘুরেফিরে। অকর্মণ্য শরীরে শিকড় গজিয়েছে ক’দিন আগেই। শিকড়গুলো শক্ত হয়ে মাটির গভীরে যাওয়ার অপেক্ষা এখন। গাছের মতো আমাকে এক জায়গায় আটকে থাকতে হবে! এই ভয়ে খুঁজে খুঁজে কাজ বের করি। বুকশেলফের পুরোনো বই পড়তে পড়তে দাড়ি কমাও মুখস্থ হয়ে যাচ্ছে। চিন্তায়, বিষাদে কোন কাজে মন বসেনা। শেষ রাতে প্রার্থনা সেরে ঘাপটি মেরে বিছানায় পড়ে থাকলেও ঘুম আসে না। অতি প্রত্যুষে বিছানা ত্যাগ করে বারান্দায় বসি। ঘরের পেছনে মোটামুটি বড় এক প্রান্তর খালি পড়ে আছে। এমন ছুটির দিনে পাড়ার ছেলেদের ক্রিকেট খেলার কোলাহলে আমার লিখালিখিতে ব্যাঘাত ঘটতো। তাদের কোলাহল উপেক্ষা করার উপায় নেই। নিজেই জড়িয়ে যাই শিশুদের কি আনন্দের কোলাহলে। আজ এইখানে দিনে দুপুরে মৃত্যৃর নীরবতা। পুরো বিশ্বে করোনার ভয়াল স্বরূপ দিনে দিনে দৃশ্যমান হচ্ছে। জ্যামিতিক হারে প্রতিদিন বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা। কেউ রেহাই পাচ্ছেন, কেউ বা অবধারিত মৃত্যুকে মেনে নিচ্ছেন। শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো ব্যর্থতা স্বীকার করছে অকপটে। ব্যর্থতার দায় মাথায় নিয়ে দায়িত্বশীল ব্যাক্তিদের আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটছে। করোনা মোকাবিলায় কার্যকর বা প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি না থাকলেও শুরু থেকেই বাঙালীদের করোনা বিতং থেমে নেই। অন্যান্য দেশে করোনার ছোবল শুরু হলে প্রবাসীদের অনেকেই জান বাঁচাতে দেশে চলে আসেন। কেউ বা আসেন স্বাভাবিক প্রয়োজনে। ‘এড়ে বাছুর বাঘ চিনে না’…..আমাদের সাথে কথাটা খুব বেশি যায়। সামাজিক দুরত্ব কথাটা বুঝতে বুঝতেই করোনা আমাদের ঘাড়ে চেপে বসেছে সিন্দাবাদের ভুতের মতো। ঢাল তলোয়ার বিহীন নিধিরাম সর্দারদের দেশের এয়ারপোর্ট পুরাই অরক্ষিত। বিদেশ থেকে প্রত্যাগতদের নির্ধারিত হোম কোয়ারেন্টিনে রাখতে প্রশাসন সহ সংশ্লিদের লেজেগোবরে অবস্থা। কোয়ারেন্টিন নিয়ে বাঙালির যুগান্তকারী সব তামাশা ঐতিহাসিক রেকর্ড প্রায় ভেঙে ফেলেছে। কিন্তু তামাশা বিন্দুমাত্র থেমে নেই। কোয়ারেন্টিনে থাকা এক ইতালি প্রবাসী সড়ক দুর্ঘটনায় আহত। কোয়ারেন্টিন কেন্দ্রের ভেতরে ঢুকে ছবি তোলায় ১৪ দিনের কোয়ারেন্টিনে বেচারা সাংবাদিক। ধামরাইয়ে কোয়ারেন্টিন সেন্টার থেকে ২৮টি সিলিং ফ্যান চুরি। চোরকে গরু খোঁজা হচ্ছে, ফ্যান উদ্ধার কিংবা শাস্তির জন্য নয়। ফুঁসলে ফাঁসলে কোনমতে তার কাছ থেকে আসল খবর জানতে হবে। করোনা বহনকারী তষ্করের পদস্পর্শে ধন্য বাড়িগুলোকে সময় থাকতে লক ডাউনের আওতায় নিয়ে আসলে সর্বনাশের মাত্রা বাড়বে বৈ কমবে না। কোয়ারেন্টিন ভেঙে বাজারে ঘোরাঘুরি করায় এক প্রবাসীকে উত্তমমধ্যম দিয়েছে গ্রামবাসী। ফলশ্রুতিতে গ্রাম সুদ্ধ লোককে গৃহবন্দি করে পুরো এলাকা লকডাউন করতে হয়েছে। আত্মীয় কুটুম্বিতার নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে বিদেশফেরতদের বিয়েও থেমে নেই। বেরসিক পুলিশের বাগড়ায় দামান্দ কন্যা যথারীতি আরো চৌদ্দদিনের সেপারেশনে। সাথে আমন্ত্রিত অতিথিরাও যে যার ঘরে বন্দি। যদিও দামান্দ বাবাজি পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে শ্বশুরবাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন ইতিমধ্যে। গাইবান্ধায় বিয়ে বাড়ির দুই আমেরিকান অতিথির দেহে করোনা শনাক্ত। উপস্থিত সাতশো অতিথিকে খুঁজতে চিরুনি অভিযান অব্যাহত। বরিশালের এক হাসপাতাল থেকে দৌড়ে পালানোর সময় করোনার রোগীকে চ্যাং-দোলা করে ধরে আনেন চার যুবক। যুবক ভাইদের এমন বীরত্বে মুগ্ধ আপ্লুত আড়াইশো এলাকাবাসী চারজনকেই কাঁধে নিয়ে আনন্দ মিছিল করেন। দুঃসাহসী পরোপকারী যুবক দল সহ আড়াইশো গ্রামবাসী কোয়ারেন্টিনে। এলাকায় কার্ফ্যু জারি।কোয়ারেন্টিনে থাকা প্রবাসীর বাড়ি কিংবা লক ডাউন বাড়ির সামনে উৎসুক মানুষের ভীড় অতি সাধারণ ঘটনা। মানুষের ঢল সামলাতে পুলিশকে বেধড়ক লাঠিচার্জ করতে হয়। পরে লাঠিসহ পুলিশের টিম কোয়ারেন্টিনে। প্রাণঘাতি করোনায় জান কবচ হওয়ার আগে করোনা নিয়ে সংঘষের জেরে একজন ইতিমধ্যে প্রাণ হারিয়েছেন। কার মাস্ক টেকসই এই নিয়ে দুই প্রতিবেশীর বিবাদ তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে। মাস্ক না মাক্স এই নিয়ে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে ৬০ জন আহত। রসিকতার কোন শেষ নেই। হেকিম, কবিরাজ, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের ঢল নেমেছে বাংলাদেশে। কভিড ১৯ নামক বৈশ্বিক মরকির বলা নির্মূলের কার্যকরি দাওয়াই আবিষ্কারে বাংলাদেশ বেশ এগিয়ে। মাইক বাজিয়ে ঔষধ ও প্রতিষেধক বিক্রি করতে গিয়ে কয়েকজনের জায়গা হয়েছে চৌদ্দ শিকের ভেতর।কিন্তু করোনার দাওয়াই আবিষ্কারের চেষ্টা থেমে নেই। রাস্তার পাশে বসে কিংবা ফার্মেসিতে ওষুধ বিক্রি নিরাপদ নয় জেনে শুরু হয়েছে ইনবক্স ব্যবস্থাপত্র। স্বপ্নে বা জাগরনে পাওয়া ঔষধের ব্যবস্থাপত্রের সাফল্যে একেকজন পুলকিত। কারণ বাংলাদেশে করোনা আক্রান্তের হার নাই বললেই চলে। করোনা নির্মূলে এক মধ্যরাতে কয়েক জায়গায় একযোগে আজান দেয়া হয়। জন্মেই এক নবজাতক কথা বলা শুরু করেছে। নিজেকে করোনা পরিচয় দিয়ে সারা দেশে একযোগে আজান দেয়ার নির্দেশ দিয়েই শিশুটি মারা যায়।দুষ্কর্মকারীদের এই মিথ্যা কাহিনির ধারাবাহিকতায় পরের দিন আরেক করোনা শিশু জন্ম নেয়। ঘটনা আগের চেয়ে এক কাঠি এগিয়ে। এইবার ভূমিষ্ঠ হওয়ার সাথে সাথেই শিশুটি দাঁড়িয়ে যায়। সবাইকে গরম মসøা, কালিজিরা সমেত লাল চা খাওয়ার নির্দেশ দিয়ে সেও ভবলীলা সাঙ্গ করে ইহধাম ত্যাগ করে। নিশি রাইতে চা খাওয়ার রাজকীয় আয়োজন সম্পন্ন। মৃত সঞ্জিবনী মহৌষধ বানাতে গিয়ে দেখা যায় ঘরে গরম মসল্লা ও কালিজিরা নেই। এতো রাতে লক ডাউন ভাঙা কিংবা দোকান খোলা পাওয়া অরণ্য রোদন। অগত্যা প্রতিবেশীই ভরসা। সোশ্যাল ডিস্টেন্সকে নিকুচি করে মাঝরাতে পাশের বাড়িতে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে ইতিমধ্যে তারাও চায়ের আয়োজনে। এক চিমটি কালি জিরা, দুই তিনটা গরম মসøা হাতের তালুতে নিয়ে সেই আসরে চা পানের মসøা মাখানো রঙচঙা সাত কাহন গাইতে গাইতে রাত প্রায় শেষ। ফেসবুকে স্ট্যাটাস, মেসেজ, ভয়েস ম্যাসেজ ও ফোনে দুনিয়ার সব আত্মীয় পরিজনকে একযোগে চা পানের আহবান জানিয়ে খুব ক্লান্ত লাগে। কিন্তু অন্তর পুরোপুরি তৃপ্ত… করোনা ব্যাটা বুঝবে এবার, ‘পড়েছো মোগলের হাতে….’করোনা শিশুর কথায় গেলাস গেলাস চা পান চলছে। ফলাফল পরের দিন থেকে কালিজিরা, গরম মসল্লা, চা পাতা বাজার আউট। অল্প কিছু যা আছে মুল্যবৃদ্ধিজনিত উত্তাপে কাছে যাওয়া যাচ্ছে না। এতো সচেতন জাতির কমনসেন্সের তোলা আবার ৪২০ টাকা। করোনা সন্দেহে কেউ মারা গেলেতো সেরেছে। দলবেঁধে লাশ দাফনে বাধা, মৃতের পরিবারকে একঘরে করে রাখা, কিছুই বাদ যায় না। ইউরোপ আমেরিকা যেখানে করোনা রোগীর চিকিৎসায় হিমশিম খাচ্ছে সেখানে বাংলাদেশ তো কিছুই না। আকিজ গ্রুপ মানবিক দায়বদ্ধতা থেকে করোনা হাসপাতাল নির্মাণ করতে চাইলে এইখানেও বাধা আসে। অবশেষে সব বাঁধা ডিঙিয়ে তৈরি হচ্ছে আমাদের করোনা হাসপাতাল। বিশ্বব্যাপী করোনায় মৃত্যু অর্ধলাখ ছাড়িয়েছে। আক্রান্তের সংখ্যা দশ লাখ তথা এক মিলিয়নেরও বেশি। ভয়াবহ সময় সম্মুখে।আল্লাহর দোহাই, তামাশা থামিয়ে নিজ নিজ বিশ্বাস থেকে সবাই স্রষ্টার কাছে মাথা নত করি। তিনি তো আমাদের বুদ্ধি, প্রজ্ঞা ও সম্মান দিয়ে অন্যান্য প্রাণী থেকে আলাদা করে রেখেছেন। সেই বুদ্ধি প্রজ্ঞার অন্তত সিকি ভাগ কাজে লাগাই। অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে কায়মনোবাক্যে সর্বশক্তিমানের কাছে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করি, এখনো আমরা বেঁচে যে আছি। ‘হে প্রভু আমাদের জ্ঞান দাও, আমাদের ক্ষমা করো।’