প্রশান্তি ডেক্স॥ বাংলাদেশের আয়তন বাড়ছে। প্রকৃতির আশীর্বাদেই জেগে উঠছে এই ভূখন্ড। এতে হাল ফিরবে দেশের অর্থনীতির। স্বপ্নের জাল বুনছে দেশের মানুষ। কক্সবাজার থেকে মাত্র ৩০ কিলোমিটার দূরে সাগরের মাঝে জেগে উঠছে সুন্দরবনের আদলে নতুন ভূমি। যেখানে তৈরি হবে নতুন শিল্প ও পর্যটনকেন্দ্র।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এতে ওই এলাকার গ্রামীণ আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নতি হবে। অর্থনৈতিকভাবে প্রচুর লাভবান হবে দেশ। সূত্র জানিয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য একটা অংশ সাগরে তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কার কথা বলছেন পরিবেশবাদীরা। এমন প্রেক্ষাপাটে বঙ্গোপসাগরের বুকে হাতছানি দিচ্ছে আরেক টুকরো বাংলাদেশ। অথই নীল জলরাশির মাঝে জেগে উঠছে মাইলের পর মাইল ভূখন্ড। প্রকৃতি ঢেলে সাজাচ্ছে বাংলাদেশকে।
নদীর ধারে যারা বসবাস করে, তাদের সমস্যার শেষ নেই। সারাক্ষণ থাকতে হয় ভাঙ্গাগড়ার খেলার মধ্যে। একদিকে নদীর পাড় ভেঙ্গে সর্বস্বান্ত হয়ে যাচ্ছে, অপরদিকে পাচ্ছে নতুন ভূমি। যোগ-বিয়োগের এই হিসাবে যোগের পাল্লাই বেশ ভারী।
পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, তিন দশক আগেও বঙ্গোপসাগরের নীল জলরাশির অংশ ছিল নোয়াখালীর চর নাঙ্গগুলিয়া। সেটি এখন সমৃদ্ধ একটি গ্রাম। ১০০ বছর ধরে পদ্মা, মেঘনা আর ব্রহ্মপুত্রের বয়ে আনা কোটি কোটি টন পলি যোগ হচ্ছে এই ভূখন্ডে। ২০১৬ সাল থেকে প্রতিবছর গড়ে বাংলাদেশে যুক্ত হচ্ছিলো ১৬ বর্গকিলোমিটার ভূমি। ২০২১ সালে এসে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২০ বর্গকিলোমিটারে। যদিও প্রতিবছর প্রায় ৩২ কিলোমিটার ভূমি নদীভাঙ্গন আর সমুদ্রে হারিয়ে যাচ্ছে।
প্রকৃতি যেমন বাংলাদেশ থেকে অনেক কিছু কেড়ে নিচ্ছে, আবার দিচ্ছেও দুহাত ভরে। বঙ্গোপসাগরের বুকে বালুকণা আর পলির সমন্বয়ে গড়া দ্বীপগুলোতে তৈরি হয়েছে প্রচুর সবুজ খামারবাড়ি। ১৯৯৪ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকার প্রায় ২৩ হাজারেরও বেশি ভূমিহীন পরিবারের জন্য ৮৩ হাজার খাসজমির বন্দোবস্ত করেছে। মেঘনার ভাঙনে যে পরিমাণ ভূমি জলে বিলীন হচ্ছে, তার বিপরীতে অন্তত ১০ গুণ ভূমি জেগে উঠছে।
সূত্র জানিয়েছে, নতুন সমৃদ্ধি নিয়ে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে ভাসান চর, উড়ির চরের মতো অসংখ্য চর ও দ্বীপ। কক্সবাজার থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে সাগরের মধ্যে জেগে উঠছে সুন্দরবনের আদলে নতুন ভূমি। সেখানে তৈরি হচ্ছে নতুন পর্যটনকেন্দ্র। বাংলাদেশ ভূখন্ডের পূর্বাঞ্চলের ভবিষ্যৎ রক্ষা করবে এই বন।
নোয়াখালীতেও বইছে উন্নয়নের জোয়ার। ক্রস ড্যাম প্রকল্পের মাধ্যমে সমুদ্র থেকে উদ্ধার করা হবে ১০ হাজার হেক্টর ভূমি। এতে ব্যয় হচ্ছে ৫৮৮ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে সহজ হবে যোগাযোগ ব্যবস্থা। ভাঙনের কবল থেকে রক্ষা পাবে কৃষিজমি, বাড়বে ফসলের উৎপাদন। স্থানীয় পর্যায়ে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে। বাড়বে কর্মসংস্থান। সোজা কথায় গ্রামীণ অর্থসামাজিক অবস্থার উন্নতি ঘটবে।
জানা গেছে, নোয়াখালী জেলার মূল ভূখন্ডের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে উড়িরচর। এই উদ্যোগ সফল করতে সমুদ্র থেকে প্রায় ১০ হাজার হেক্টর ভূমি পুনরুদ্ধারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এই ভূমি পুনরুদ্ধারের জন্য উড়িরচর-নোয়াখালীতে নির্মাণ করা হবে ক্রস ড্যাম। নোয়াখালী জেলার কোম্পানীগঞ্জ ও সুবর্ণচর উপজেলায় সাত কিলোমিটারেরও বেশি লম্বা ক্রস ড্যাম ও টাই বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে উড়িরচরের সঙ্গে নোয়াখালীর মূল ভূখন্ডের স্থায়ী যোগাযোগ স্থাপন করা সম্ভব হবে। এ জন্য একটি প্রকল্প গ্রহণ করেছে সরকার। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
২০০৭ সালের তথ্যমতে, উড়ির চর ইউনিয়নের আয়তন ২৬ হাজার এক একর বা ১০৫ দশমিক ২৩ বর্গকিলোমিটার। ২০১১ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, উড়ির চর ইউনিয়নের লোকসংখ্যা ১১ হাজার ৯২৩ জন। এর মধ্যে পুরুষ ৬ হাজার ৪২৫ জন ও নারী ৫ হাজার ৪৯৮ জন। সন্ধীপ ইউনিয়নের দক্ষিণ-পূর্বে সন্ধীপ চ্যানেল ও সন্তোষপুর ইউনিয়ন। পূর্বে সন্ধীপ চ্যানেল ও মীরসরাই উপজেলার সাহেরখালী ইউনিয়ন। উত্তরে সন্ধীপ চ্যানেল ও নোয়াখালী জেলার কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার মুছাপুর ইউনিয়ন। পশ্চিমে নোয়াখালী জেলার কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার চর এলাহী ইউনিয়ন, সন্ধীপ চ্যানেল ও সুবর্ণচর উপজেলার চর ক্লার্ক ইউনিয়ন এবং দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর।
এসব নতুন দ্বীপ ও চর নিয়ে সরকারের নতুন নতুন পরিকল্পনা রয়েছে। ইতোমধ্যে এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের নির্দেশনা দিয়েছে সরকার। যেভাবে জনসংখ্যা বাড়ছে, তাতে দ্রুত কমে যাচ্ছে কৃষিজমি। শিল্পায়নে জমির স্বল্পতা ঘটছে, সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে সাগরের বুকে জেগে ওঠা এই ভূমি বাংলাদেশের জন্য এক নতুন সম্ভাবনা।
আগামী ২০ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে চর আর দ্বীপগুলোর ভূমির মান উন্নত হবে। দেশটি রক্ষা পাবে প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে। প্রয়োজন অনুসারে শিল্প ও পর্যটন খাত, আর পরিকল্পিত আবাসনের ক্ষেত্রে এসব চর আর দ্বীপ ব্যবহার করা হবে। প্রাকৃতিকভাবে ভূমি গঠন নতুন নয়। তবে যেকোনও দেশের জন্য এটি অনেক বড় পাওয়া।
পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে উড়ির চরের সঙ্গে নোয়াখালীর মূল ভূখন্ডের যোগাযোগ স্থাপন সম্ভব হবে। কৃষিজমি ভাঙ্গনের কবল থেকে রক্ষার মাধ্যমে কৃষি উৎপাদন বাড়বে। স্থানীয় পর্যায়ে খাদ্য নিরাপত্তা বাড়ানো এবং কর্মসংস্থান বৃদ্ধির মাধ্যমে প্রকল্প এলাকার দারিদ্র্য হ্রাস করা সম্ভব হবে। ফলে গ্রামীণ আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নতি সাধিত হবে।
এ প্রসঙ্গে নোয়াখালীর জেলা প্রশাসক দেওয়ান মাহবুবুর রহমান জানিয়েছেন, সাগরের বুকে জেগে ওঠা এই ভূমি বাংলাদেশের নতুন সম্ভাবনা। আগামী ২০ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে চর আর দ্বীপগুলোর ভূমির মান অনেক উন্নত হবে। এর ফলে বাংলাদেশ প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে অনেকটাই রক্ষা পাবে। সে সময় প্রয়োজন অনুসারে শিল্প ও পর্যটন খাত আর পরিকল্পিত আবাসনের ক্ষেত্রে এসব চর আর দ্বীপগুলো ব্যবহার করা সম্ভব হবে।
তিনি আরও জানান, ইতোমধ্যেই সরকার ‘ভূমি পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে উড়ির চর-নোয়াখালী ক্রস ড্যাম নির্মাণ’ শীর্ষক একটি প্রকল্প গ্রহণ করেছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে কৃষি উৎপাদন, স্থানীয় পর্যায়ে খাদ্য নিরাপত্তা এবং কর্মসংস্থান বৃদ্ধির মাধ্যমে প্রকল্প এলাকার দারিদ্র্য হ্রাস করা সম্ভব হবে। ফলে গ্রামীণ আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নতি সাধিত হবে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম জানিয়েছেন, সমুদ্র হবে বাংলাদেশের সম্পদ। সমুদের বুকে জেগে উঠছে হাজার হাজার একর জমি। এগুলোই হবে আগামী বাংলাদেশের সম্পদ। এ বিষয়ে নিয়ে সরকারের অনেক পরিকল্পনা রয়েছে। পাশাপাশি বাংলাদেশ ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০-তে নদী তীর সংরক্ষণ, নদী ও খাল খনন, পুনঃখননের মাধ্যমে বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও নদীভাঙ্গন রোধ করে দুর্যোগ ঝুঁকি প্রশমন, জানমালের নিরাপত্তা ও কৃষি উৎপাদন বাড়ানোর ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। এ কারণে সমুদ্র থেকে ১০ হাজার হেক্টর ভূমি পুনরুদ্ধারের সিদ্ধান্ত সংক্রান্ত প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে ওই এলাকার গ্রামীণ আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নতি হবে।